আমার নাম হিমু।
শুরুতেই এরকম একটা লাইন পড়ে মনে হতে পারে এটা হুমায়ুন আহমেদের 'হিমু' সংশ্লিষ্ট কোন উপন্যাসের শুরু কিনা। না, ভনিতা না করে আমি সরাসরি লিখেছি যে আমার নাম হিমু। আমার পারিবারিক নাম বা ডাক নাম। এই নাম একসময় কারো কাছে বলতে গেলে দ্বিধা হতো। যে নামের কোন অর্থ নেই, কোন নামের ভগ্নাংশও নয়, যেমন হেমাঙ্গিনীর হিমু অথবা হিমাংশুর। হিমালয়েরও নয়। তাহলে এই নাম বলে বলে বেড়াই কি করে! এই নাম আর কারও আছে সেও শোনা যেতো না। জীবনে শুধু একটা জায়গাতেই দেখেছিলাম সে হলো ইতিহাসের বইয়ে। আদিল শাহ্র সেনাপতি ছিলেন। তাও একটা লাইনেই সীমাবদ্ধ। অনেকে আসল নামের শেষে ডাক নামটাও জুড়ে দেয়, আমি সে কাজটাও করিনি ঐ একটা কারনেই। দ্বিধা নিয়ে তারুণ্য পার করে দিয়েছি। কিন্তু যখন দেখলাম হুমায়ুন আহমেদ তার উপন্যাসে 'হিমু' নামের চরিত্র নিয়ে এসেছেন, আমি সত্যি খুব আশ্চর্য হলাম এই নামটা তিনি কোথায় পেলেন! কি কারনে কোথা থেকে তিনি এই নামটা নির্বাচন করলেন! তখন আমি নড়েচড়ে উঠি, নিজেকে টেনে তুলি। ভাবতে থাকি, নাঃ আমার নামটা তাহলে খারাপ নয়, যথেষ্ট ওজন আছে। সেই থেকে আর দ্বিধা করি না। কিন্তু এখন আরেকটা মুশকিল হলো এরপর আমার নামটা কাউকে বলতে গেলে মনে করে আমি বুঝি নিজেকে হুমায়ুন আহমেদের 'হিমু' চরিত্রকে ধার করতে চাইছি। হুমায়ুন আহমেদ আমাকে কিছুটা হলেও বিখ্যাত করেছেন সন্দেহ নেই।
হুমায়ুন আহমেদের প্রায় সবগুলো হিমুই পড়া হয়ে গেছে। দেশের বাইরে যখন প্রবাসে থেকেছি, দেশে বেড়াতে এসে প্যাক করে যা পারতাম কিনে নিয়ে যেতাম। তবে 'হিমু' চরিত্রের সঙ্গে আমার কোন সাদৃশ্য নেই। হিমু যা করে আমি তা করি না। কিন্তু হিমুর কর্মকান্ড খারাপ লাগে না। ওর ভাবনা-চিন্তার সঙ্গে একাত্ম হতে ভাল লাগে। ওর সোজা সাপটা জাবাবগুলো বারবার পড়তে ইচ্ছে করে। জীবনকে এত সহজভাবে নিয়ে তাকে শাসন করার সাহস শুধু হিমুই পারে।
আমি যখন প্রবাসে, আফ্রিকাতে ছিলাম অনেকদিন। বাংলাদেশের বাঙ্গালীদের পাশাপাশি পশ্চিম বঙ্গের বাঙ্গালীদের কমিউনিটিও ছিল বেশ বড়। আমরা বেশ কিছুদিন এক সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতাম। একটা পাঠাগার ছিল, দুই বাংলা মিলে পরিচালনা করা হতো। ঐ পাঠাগারেই একদিন পশ্চিম বঙ্গের এক ভদ্রলোক, হাল্কা লেখালেখি করেন দেয়াল পত্রিকা কিংবা বার্ষিক স্মরনিকায়। তিনি খুব বিস্ময় নিয়ে জানতে চেয়েছিলেন যে হুমায়ুন আহমেদ এত জনপ্রিয় কেন? আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম যে তিনি তার কোন বই পড়েছেন কিনা। তিনি জবাব দিয়েছিলেন 'হ্যা, কিন্তু লেখায় তো আহামরি কিছু নেই! শব্দচয়ন খুবই সাদামাটা, সাহিত্যিক বিন্যাস সাধারন।' শুনে আমার রাগ হলেও বললাম, পড়তে কেমন লাগে?
এবার তিনি বললেন, এটা ঠিক যে তিনি পাঠককে ধরে রাখতে পারেন। বুঝলাম তিনি বই শেষ না করে উঠতে পারেননি। আমি বললাম, এটাই হচ্ছে তার জনপ্রিয়তার কারন। তিনি কোন লেখাতেই বিরক্তির উদ্রেক ঘটান না। সহজ-সাবলিল ভাষায় লিখে যান মানুষের কথা, সমাজের কথা, যা প্রতিদিন ঘটে সেসবের কথা। সবচেয়ে বড় কথা পাঠকরা তার লেখা চরিত্রগুলোর মাঝে নিজেদের খুঁজে পান।
তিনি আরও জানতে চেয়েছিলেন যে 'হিমু' চরিত্র এতো জনপ্রিয় কেন? আমি জবাবে বলেছিলাম যে হিমু কেবল একটা চরিত্র মাত্র নয়, অনেক হিমু ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশে যাদের মনের কথা, আশা-আকাঙ্ক্ষা এই হিমুর মাঝে ফুটে ওঠে। আর তাই 'হিমু' এতো জনপ্রিয়।
আসলে অনেকেই আছেন যারা সাহিত্য-উপন্যাস বলতে বিমল মিত্র-তারাঙ্কর-আশুতোষদের খুঁজে পেতে চান এবং সেটা অমূলকও নয়। কারন সাহিত্য গ্রন্থ রচনায় যে ধ্রুপদ শাব্দিক সমাহরণ এবং বর্ণনা, এইসব তার লেখায় তেমন করে পাওয়া যায় না। যদিও সেই ব্যাপারগুলো অনেক সময়ই পাঠকদের বিরক্তির উদ্রেক করে এবং অনেক লেখকই সেইসব কারনে ভাল লেখক হয়েও পাঠক প্রিয়তা কম পেয়েছেন। আসলে সাধারনভাবেই যে সুন্দর তাকে অতি অলংকরনের প্রয়োজন পড়ে না। বেছে বেছে জায়গায় বসাতে পারলেই হয়। কিন্তু অলংকারের বাক্স হুমায়ুনের ঠিকই ছিল, বের করেতেন খুব হিসেব করে, তার প্রমানও আছে তার অনেক লেখায়ই। তিনি কথাসাহিত্যের গতানুগতিক ধারাকে ভেঙ্গেছেন সন্দেহ নেই।
আর কি পাহাড় সমান প্রতিভা ছিল তার! কোথায় বিচরন করেন নি তিনি? পঠকদের রেখেছেন আচ্ছন্ন, দর্শকদের রেখেছেন মোহাচ্ছন্ন।
এসব যখন লিখছি হঠাৎ করেই মনে হলো কেন লিখছি! হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে কি লেখার যোগ্যতা আমার আছে! যা লিখেছি সবই আমার সাধারন অনুভূতির প্রকাশের চেষ্টা মাত্র। একজন মহারথিকে নিয়ে আমার লেখার দুঃসাহস নেই।
ভাবতে কষ্ট হয় যে একটা "হুমায়ুন আহমেদ-ক্রেইজ" তৈরি হয়েছিল, তা শেষ হয়ে গেল। আশির দশকের সেই 'এইসব দিনরাত্রি', 'বাকের ভাই', তারপর আর বিশেষভাবে কিছু নয়, শুধুই হুমায়ুন আহমেদ..সবকিছুই বিশেষিত। হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে উৎসারিত কিছু সূক্ষ্ম সুখানুভূতি তিনি জিবনের ভিতর উপভোগ করতে চেয়েছিলেন এবং তা বাস্তবে নামিয়ে এনে অনুভব করতে পেরেছিলেন হয়তো। যেমন, চাঁদনী প্রসর রাত, গাছ-গাছালির সঙ্গে বসবাস আর তাই তার প্রিয় 'নুহাস পল্লী' এবং সেখানে বসেই উপভোগ করেছেন 'ঘন বর্ষণের' নুপুর ছন্দ। আর কখনো 'হিমু' কিংবা 'মিছির আলী'র নতুন কোন উপাখ্যান শোনা যাবে না। তারাও থেমে গেছে। তবে তারা এবং আরও অনেকেই রয়ে যাবেন মানুষের মনে, বারবার তাদেরকে এই বাংলার মানুষ দেখতে চাইবেন অনেকদিন। কারন হুময়ুন আহমেদ উপন্যাস পড়তে এবং নাটক-ছবি দেখতে শিখিয়েছেন, নেশার মত করে। তার বই মাঝপথে পড়া বন্ধ করে উঠে যাওয়া বেশ একটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। নাটকগুলো জীবনের কথা বলে বলেই সব কাজ ফেলে সবাই টেলিভিশনের সামনে আগেভাগই জায়গা করে নিতো, আনুভবে এতটাই গভীরে চলে যায় বলেই মানুষ 'বাকের ভাই'-এর জন্য মিছিল করে! 'হিমু' হয়ে ঘুরে বেড়াতে ভালবাসে। এইসব সম্ভব হয়েছে শুধু হুমায়ুন আহমেদ বলেই। আরও অনেক প্রথিতযশা লেখকদের সম্মান জানিয়েও বলতে হয়..হুমায়ুন আহমেদ ছিলেন একজন 'অন্যরকম' লেখক, তুলনাহীন। “Life dies but forever will there be music…always.” আমরা তাঁর শব্দের মূর্ছনা শুনতেই থাকবো।
২৩ অক্টোবর - ২০১৩
গল্প/কবিতা:
১৬ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪